-শেখ মীরু
“ও কূল ভাঙা নদীরে ... আমার চোখের নীর এনেছি মেশাতে তোর
নীরে ... ও কূল ভাঙা নদীরে” -
গানটা নিজের মনে গুনগুন করতে করতে ফারহীন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
সূর্য অনেক্ আগেই অস্ত গেছে। অন্ধকার
ঘনিয়ে এলেও উত্তর-পূর্ব কোণে ওঠা চাঁদটার জোছনায় পরিবেশটা বেশ পরিষ্কার। আগামী
আলোর অপেক্ষায় ঘুমন্ত পদ্মফুলগুলোর মাঝে পুকুরের জলে চাঁদটার পূর্ণ প্রতিচ্ছবি।
পাড়ে গন্ধরাজ ফুলের সুবাস পরিবেশটাকে আরও মায়াবী করে তুলেছে।
তবে এগুলো ফারহীনের কাছে নতুন কিছু নয়। ও
প্রায়ই আসে এখানে। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে শান-বাঁধানো ঘাট, ওখানেই বসে ফারহীন। কেন জানে না এই
পরিবেশটাকে ওর বড় আপন মনে হয়। ওর মনের সত্য-মিথ্যে অনুভূতিগুলোকে বোঝে
শুধু এই বহুদিনের পরিচিত পরিবেশটাই। তাই মন খারাপ হলেই
ও এখানে চলে আসে। তবে আজ যেন ওর ইন্দ্রিয়গুলো একটু বেশিই
সচেতন হয়ে উঠেছে। বাঁধানো ঘাটের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে ফারহীন ভাবতে চেষ্টা করে ওর
উনিশ বছরের জীবনটাকে।
বাবাকে ওর কখনই মনে পড়ে না। মাকেও হারায়
মাত্র সাত বছর বয়সেই। তার পর থেকে মাসির কাছেই ও বড়ো হয়েছে। এই গ্রামের
স্কুলেই গতবছর উচ্চমাধ্যামিক পাস করেছে ও। ফারহীন যখন ক্লাশ ইলেভেনে পড়ে তখনই
পরিচয় হয় জুনাইদের সাথে। প্রথম প্রথম জুনাইদকে খুব ভাল লাগত ফারহীনের। তারপর কখন যে সেই
ভাললাগা ভালোবাসায় পরিণত হয় ফারহীন মোটেই বুঝতে পারে নি। এদিকে জুনাইদও ফারহীনকে
ভালবেসে ফেলে। কিন্তু ওদের এই ভালবাসার কথা কেওই জানতো না, শুধু ওরা দুজন ছাড়া।
এরপর ক্রমসঃ ওদের মানসিক ঘনিস্থতা গভীর হতে থাকে। ওরা দুজনেই বাস্তব জগতটাকে
ভুলে এক আবেগময় কল্পনার জগতে প্রবেশ করতে থাকে। এমনই এক চরম আবেগময় মুহূর্তে ফারহীন নিজের
অজান্তেই তার মনের সাথে দেহটাকেও সঁপে দেয় জুনাইদকে...... এসব ভাবতে ভাবতে ফারহীন
এতই মগ্ন হয়ে যায় যে সে বুঝতেই পারেনি কখন তার পেছনে আর একটি নারীশরীর এসে বসেছে।
হঠাৎ ফারহীনের মনে হয়
হয়তো অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। সে বাড়ি ফেরার জন্য পিছন ফিরতেই দেখতে পায় মেয়েটিকে। -“এমা
প্রীতি তুই? কখন এলি? আর এভাবে মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন?” প্রীতি ওর দিকে তাকায়।
চাঁদের আলোয় ওর চোখের তারাদুটো চকচক করে ওঠে। -“এমা প্রীতি তুই কাঁদছিস ? কি হয়েছে বলবি তো!” প্রীতি ভেজা ভেজা গলায় বলতে
থাকে, “ফারহীন, তুই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু,
তোর কাছে আমি কোনও কথাই গোপন করি না, কিন্তু আজ একটা কথা তকে বলবো যেটা আমি বহুদিন
থেকে তোর কাছে লুকিয়ে রেখেছি।” ফারহীন প্রীতির দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। প্রীতি
বলতে থাকে, “ফারহীন, আমি একটা ছেলেকে ভালবাসি ক্লাশ টেন থেকে, ও আমায় বিয়েও করবে
বলেছিল, আর আমি ভাবতেও পারিনি যে...” প্রীতি কেঁদে ফেলে। ফারহীন ওকে কাছে টেনে নেয়।
প্রীতি কান্নাভেজা গলায় বলতে থাকে –“ফারহীন, আমি এখন গর্ভবতী, আর ও এখন আমায়
অস্বীকার করছে ... বল এখন আমি কি করব?” বলতে বলতে প্রীতি কাঁদতে থাকে। ফারহীন বলে,
“আশ্চর্য! এমনও ছেলে হয়? আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। আচ্ছা,
ছেলেটা কে? বল, আমি নিজে গিয়ে কথা বলবো ওর সাথে। তোর জীবন নিয়ে
খেলা করার ওর কোন অধিকার নেই, নাম কি ছেলেটার?” প্রীতি উত্তর দেয় –“জুনাইদ” । “জুনাইদ?”- ফারহীন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
-“এটা কি করে সম্ভব? তুই মিথ্যা বলছিস।” “না ফারহীন, আমি মিথ্যা বলছি না, এটাই সত্যি।”
ফারহীন আর ভাবতে পারছে না। এখন এই
বহুদিনের পরিচিত পরিবেশটাকেও মনে হচ্ছে ঠগ,
মিথ্যা, সব মিথ্যা, গন্ধরাজ ফুলগুলোকে যেন ভুলের মত মনে হচ্ছে তার। প্রতারক
চাঁদটারও দুটো চেহারা...একটা আকাশে...একটা জলে। সে রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে একটা পাথর
তুলে জলের মধ্যে চাঁদের প্রতিচ্ছবিটার দিকে ছুঁড়ে মারে। জলের ঢেউয়ে চাঁদটা হারিয়ে
যায়। কিন্তু কতক্ষন? ধীরে ধীরে চাঁদটা আবার জলের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে
ফারহীনও বুঝতে পারে বাস্তবটাকে। সে “মা-আ-আ” বলে জোরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। প্রীতি বুঝে উঠতে পারে না ফারহীনের এই কান্নার কারণ।
...দু ফোঁটা লোনা জল পাড়ে পড়ে
পুকুরের মিষ্টি জলের দিকে গড়িয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে যায় ।
---সমাপ্ত---
দু ফোঁটা লোনা জল, সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের একটি নতুন বাংলা ছোটগল্প – SAD
BANGLA SHORT STORY, ভিন্ন স্বাদের বাংলা
ছোটগল্প, বাংলা ছোটগল্প, বাংলা, ছোটগল্প, BENGALI SHORT STORY,
BANGLA CHHOTO GOLPO, দুঃখের বাংলা ছোটগল্প